বাংলা ও সংস্কৃত ধাতুর সাধারণ আলোচনাঃ
সংস্কৃত বৈয়াকরণগণ সংস্কৃত ভাষার ধাতুর তালিকা তৈরি করে দিয়েছেন। তাঁদের মতে, সংস্কৃত ভাষায় প্রায় ২,০০০ ধাতু আছে। অবশ্য বেন, ব্রাহ্মণ, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে ৭০০-র বেশি ধাতুর ব্যবহার দেখা যায় না। এগুলো হচ্ছে “সিদ্ধ ধাতু’ বা ‘মৌলিক ধাতু। বাংলা ভাষায় সিদ্ধ, সাধিত প্রভৃতি সব ধরনের ধাতুর সংখ্যা ১,৫০০ বা তার কিছু বেশি হবে। এ ১.৫০ ধাতুর মধ্যে অনেকগুলো আবার বর্তমানের বাংলা ভাষায় লোপ পেয়েছে বা পাচ্ছে। যেমন— ‘পুছ’ বা ‘শুথা’ ধাতু “জিজ্ঞাসা ‘কর’ ধাতুর প্রভাবে প্রায় অপ্রচলিত হয়ে গিয়েছে ।আমাদের বাংলা ভাষায় বহু ক্রিয়াপদ রয়েছে। সেসব ক্রিয়াপদের মূল অংশকে ধাতু বা ক্রিয়ামূল বলা হয়। অর্থাৎ ক্রিয়াপদকে ভাঙলে বা বিশ্লেষণ করলে এমন একটি অংশ পাওয়া যায় যাকে আর ভাঙা যায় না এবং যার মধ্যে ক্রিয়ার মূল অর্থ নিহিত থাকে, তাকে ক্রিয়ামূল বা ধাতু বলে যেমন আমি কবিতা পড়ি । তুমি গল্প পড়বে ।
উপরের দুটো বাক্যের ক্রিয়াপদকে ভাঙলে দুটোরই মূল পাওয়া যায়। যেমন- পড়, পড় + ই = পড়ি, পড় + বে = পড়বে। ক্রিয়াপদকে ভাঙলে দুটো অংশ পাওয়া যায়। মূল অংশটিকে বলে ধাতু বা ক্রিয়ামূল এবং অপর অংশটিকে বলে ক্রিয়া বিভক্তি। ক্রিয়াপদ থেকে ক্রিয়া বিভক্তি বাদ দিলে যা থাকে তাই ধাতু। উপরের বাক্যদ্বয়ে ‘ই’ এবং ‘বে’ হচ্ছে ক্রিয়া বিভক্তি। পড় ধাতুর সঙ্গে ক্রিয়া বিভক্তি ‘ই’ এবং ‘বে’ যুক্ত হয়ে গঠিত হয়েছে ক্রিয়াপদ পড়ি এবং পড়বে। ধাতু বোঝানোর জন্য বাংলা ব্যাকরণে ধাতুর পূর্বে : একটি চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। এটি মূলত ধাতুর চিহ্ন। যেমন- পড় (ধাতু) + ছে (ক্রিয়া বিভক্তি) = পড়ছে।
প্রচলিত বেশ কিছু ক্রিয়ামূল চেনার একটা সহজ উপায় হলো বর্তমান কালে মধ্যম পুরুষের তুচ্ছার্থে অনুজ্ঞায় রূপটি । যেমন— তুই পড়, তুই কা, তুই খা, তুই যা, তুই দেখ, তুই ডাক, তুই বল, তুই শুন, তুই দেখ ইত্যাদি। এগুলো যেমন ধাতু তেমনই মধ্যম পুরুষের তুচ্ছার্থক ক্রিয়াপদও। সাধারণত ধাতুর সাথে ক্রিয়া বিভক্তি বা প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ক্রিয়াপদ গঠিত হয়।
ধাতুর প্রকারভেদ বর্ণনা করঃ
ধাতু তিন প্রকার । যথা-
১. মৌলিক ধাতু,
২. সাধিত ধাতু ও
৩. যৌগিক বা সংযোগমূলক ধাতু ।
১. মৌলিক ধাতু: যে সকল ধাতুকে ভাঙা বা বিশ্লেষণ করা যায় না সেগুলোকেই মৌলিক ধাতু বলে । মৌলিক ধাতুকে সিদ্ধ বা স্বয়ংসিদ্ধ ধাতুও বলা হয়। যেমন— পড়ু, কর্, চল, দেখ, যা, খা, শো, শুনু, হ ইত্যাদি ।
মৌলিক ধাতুর প্রকারভেদ: বাংলা ভাষায় মৌলিক ধাতুকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: (ক) বাংলা বা খাঁটি বাংলা ধাতু, (খ) সংস্কৃত ধাতু ও (গ) বিদেশি ধাতু ।
(ক) বাংলা বা খাঁটি বাংলা ধাতু: যেসব ধাতু প্রাকৃত ও অপভ্রংশের মাধ্যমে বা অন্যভাবে বাংলা ভাষায় এসেছে সেগুলোকে খাঁটি বাংলা ধাতু বলে । এসব ধাতু সংস্কৃত থেকে সোজাসুজি বাংলায় আসেনি । যেমনঃ
আঁক্, কাট, কর্, কাঁদ, খা, নাচ্, ছিড়, শুন, জান্ ইত্যাদি । এগুলো থেকে বাংলা ক্রিয়াপদ আঁকা বা আঁকি, কাটা বা কাটে, করা, করি বা করবে, কাঁদবে প্রভৃতি গঠিত হয় । এসব ধাতু সাধিত শব্দ বা কৃদন্ত শব্দ তৈরি হয়েছে ।
(খ) সংস্কৃত ধাতুঃ তৎসম ক্রিয়াপদের মূলকে সংস্কৃত ধাতু বলা হয় যেমন- কৃ, গম্, ধৃ, গঠ, পঠ, হস্, হৃ ইত্যাদি ।
(গ) বিদেশি ধাতুঃ হিন্দি, আরবি ও ফারসি ভাষা থেকে যেসব ধাতু বা ক্রিয়ামূল বাংলা ভাষায় এসেছে সেগুলোকে বিদেশি ধাতু বলে । যেমন— ভিক্ষে মেগে খায়। এ বাক্যে ‘মাগ্’ ধাতু হিন্দি ‘মাঙ’ থেকে আগত । তাছাড়াও কতকগুলো ক্রিয়ামূল রয়েছে যাদের ক্রিয়ামূলের মূল ভাষা নির্ণয় করা কঠিন। এ ধরনের ক্রিয়ামূলকে বলা হয় অজ্ঞাতমূল ধাতু যেমন- ‘হের ঐ দুয়ারে দাঁড়িয়ে কে? এ বাক্যে ‘হের’ ধাতুটি কোন ভাষা থেকে আগত তা জানা যায় না। তাই এটি অজ্ঞাতমূল ধাতু ।
২.সাধিত ধাতুর প্রকারভেদ: গঠনরীতি ও অর্থের দিক থেকে সাধিত ধাতু তিন শ্রেণিতে বিভক্ত । যথা- (ক) প্রযোজক (ণিজন্ত ধাতু, (খ) নাম ধাতু ও (গ) কর্মবাচ্যের ধাতু ।
(ক) প্রযোজক ধাতু: মৌলিক ধাতুর পরে প্রেরণার্থ (অপরকে নিয়োজিত করা অর্থে) আ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে প্রযোজক ধাতু বা ণিজন্ত ধাতু গঠিত হয় । যেমন- কর্ + আ = করা, পড় + আ = পড়া।
এখানে নিজে না করে অন্যকে দিয়ে করায় । তেমনই নিজে পড়ে না, অন্যকে দিয়ে পড়ানো হচ্ছে । যেমনঃ
কর + আ = করা (করানো), পড়ু + আ = পড়া (পড়ানো), ঘুম্ + আ = ঘুমা (ঘুমানো), খা + আ = খাওয়া খাওয়ানো)।
(খ) নাম ধাতু: বিশেষ্য, বিশেষণ এবং অনুকার অব্যয়ের পরে ‘আ’ প্রত্যয় যোগ করে যে নতুন ধাতু গঠিত হয় তাকে নাম ধাতু বলে । অথবা নাম পদের পরে ‘আ’ প্রত্যয় যোগে যে নতুন ধাতু গঠিত হয় তাকে নাম ধাতু বলে । যেমনঃ
সে ঘুমাচ্ছে । ঘুম্ থেকে নাম ধাতু ঘুমা (ঘুমানো); চমক থেকে নাম ধাতু চমকা (চমকানো), বেত্ থেকে নাম ধাতু বেতান (বেতানো), ধমক্ থেকে নাম ধাতু ধমকা (ধমকানো) যেমন- আমাকে ধমকিওনা ।
(গ) কর্মবাচ্যের ধাতু: মৌলিক ধাতুর সঙ্গে ‘আ’ প্রত্যয় যোগে কর্মবাচ্যের ধাতু সাধিত হয়। এটি বাক্যমধ্যস্থ কর্মপদের অনুসারী ক্রিয়ার ধাতু । যথা- দেখ + আ = দেখা; কাজটি ভালো দেখায় না। হার + আ = হারা; ‘যা কিছু গিন্নী বলেন, কেষ্টা বেটাই চোর।’
বি.দ্র.: ‘কর্মবাচ্যের ধাতু বলে আলাদা নামকরণের প্রয়োজন নেই। কারণ, এটি প্রযোজক ধাতুরই অন্তর্ভুক্ত। যেমন: ‘দেখায়’ এবং ‘হারায় প্রযোজক ধাতু।
৩. যৌগিক ধাতু বা সংযোগমূলক ধাতু বিশেষ্য: বিশেষণ বা ধ্বন্যাত্মক অব্যয়ের সঙ্গে দে, কর্, পা, খা, হ, ছাড় ইত্যাদি মৌলিক ধাতু যুক্ত হয়ে যে নতুন ধাতু গঠিত হয়, তাকেই যৌগিক ধাতু বা সংযোগমূলক ধাতু বলে। যেমন— যোগ (বিশেষ্য পদ) + কর (ধাতু) = ‘যোগ কর’ (সংযোগমূলক ধাতু)। বাক্য- ভিনের সঙ্গে পাঁচ যোগ করো। সাবধান (বিশেষ্য) + হ (ধাতু) = সাবধান হ (সংযোগমূলক ধাতু) । বাক্য – এখনও সাবধান হও, নতুবা আখেরে খারাপ হবে। সংযোগমূলক ধাতুজাত ক্রিয়া সকর্মক ও অকর্মক দুই-ই হতে পারে ।